আয়তনের দিক থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের সবচেয়ে বড় শতবর্ষ পুরনো চা বাগান ভোটের প্রাক্কালে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। শুধুমাত্র বাগানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধই হয়নি, বাগানের শ্রমিকরা দীর্ঘদিনের বকেয়া মজুরি না পাওয়ায় বাগান শ্রমিকরা দিনের আলোতে প্রকাশ্যে বাগানের জেনারেল ম্যানেজার এবং সিনিয়র ম্যানেজারকে বেধড়ক মারধর করে বাগান থেকে তাড়িয়ে দেয়। ঘটনার দুই দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও পুলিশ আজ অব্দি কোনো ধরনের ভুমিকা নেয়নি বলে বাগান কর্তৃপক্ষ জানায়। ঘটনা কৈলাসহরের মূর্তিছড়া চা বাগানে। এই ঘটনায় মূর্তিছড়া চা বাগানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, রাজ্যের বিজেপি সরকার এবং বিজেপি দলের পক্ষ থেকে সারা রাজ্যে প্রচার করে বলে হচ্ছে, ত্রিপুরা রাজ্যে সুশাসন চলছে। রাজ্যের শ্রমিকরা কোথাও কাজ না পেয়ে না খেয়ে মারা যাবার খবর নেই, ত্রিপুরা রাজ্যের বিজেপি সরকার শ্রমিকের সরকার। রাজ্য সরকার কিংবা বিজেপি দলের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, বাস্তব কিন্তু উল্টো, বাস্তব অন্য কথা বলছে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বিজয় আগরওয়াল ১৯১৭সালে কৈলাসহরের মূর্তিছড়া গ্রামে মূর্তিছড়া চা বাগানটি তৈরী করেছিলেন। একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই মূর্তিছড়া চা বাগানটি আয়তনের দিক দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় চা বাগান। বিগত কয়েক বছর ধরে মূর্তিছড়া চা বাগানটি বেশ কিছু সমস্যা জর্জরিত।

পনেরো জানুয়ারি রোববার সন্ধ্যায় কৈলাসহর শহরের এক বেসরকারি হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে মূর্তিছড়া চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার গুপ্তা এবং বাগানের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সোমনাথ চক্রবর্তী জানান যে,  গত তেরো জানুয়ারি শুক্রবার সকালে মূর্তিছড়া চা বাগানের শ্রমিকরা কাজে যাবার সময় শ্রমিকদের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেবার দাবী করতে থাকেন বাগানের শ্রমিকরা। তখন দুমাস হয়েছে কাজে যোগ দেওয়া ম্যানেজার রাজকুমার গুপ্তা সহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং বলেন যে, পূর্ববর্তী ম্যানেজারের সময়ের যে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে তার মধ্যে ইতিমধ্যেই তাদের সত্তর হাজার টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন মাত্র দু-মাস হয়েছে এই বাগানে এসেছেন। এর মধ্যেই বকেয়া টাকার সত্তর হাজার টাকা শ্রমিকদের পাইয়ে দিয়েছেন মালিক পক্ষের সাথে কথা বলে। অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করলে মালিক বাকি টাকাও ধীরে ধীরে দিয়ে দেবেন। ম্যানেজারের কোনো কথাই শুনতে রাজি ছিলনা বাগান শ্রমিকরা। একসময় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠে যে, শ্রমিকরা ম্যানেজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে মারধোর করতে শুরু করে। ম্যানেজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তাদের বার বার বারণ করা সত্তেও ম্যানেজারকে মেরে উনার কাপড় ছিড়ে ফেলা হয়। ম্যানেজারের গলায় জুতার মালাও পড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তার সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। একসময় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রায় অর্ধ নগ্ন অবস্থায় একটি ইরিকশা ধরে শহরের দিকে যাবার চেষ্টা করলে ইরিক্সা চালককে হুমকি দেয় ম্যানেজারকে না নিয়ে যাবার জন্য উত্তেজিত শ্রমিকরা। সেখান থেকেই কোলকাতায় মালিকের কাছে ফোন করেন ম্যানেজার। তখন মালিক নির্দেশ দেন যে, শহরের একটি কাপড়ের দোকানে গিয়ে যেন উনারা কাপড়, জুতা ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেন। লজ্জায় অপমানে মূর্তিছড়া চা-বাগান থেকে প্রায় দশ কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে  ম্যানেজার ও এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজাররা অর্ধ নগ্ন অবস্থায় শহরে আসেন। শহরে এসে কাপড়,জুতো ও নানান সামগ্রী কিনে একটি বেসরকারি হোটেলে রাত্রি যাপন করেন। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে মালিক পক্ষের নির্দেশেই ভিডিও ফুটেজ ও নানান তথ্য সহ কৈলাসহর থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে কৈলাসহর থানার ওসি ও মহকুমা পুলিশ আধিকারিককে জানানো হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পুলিশ আজ অব্দি কোন আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি বলে সাংবাদিক সম্মেলনে উনারা বলেন। এই ঘটনার জন্য মূর্তিছড়া চা-বাগান কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাগান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি লক আউটের নোটিশ বাগানের অফিসে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে

সাংবাদিক সম্মেলনে, বাগানের এসিস্ট্যান্ট সোমনাথ চক্রবর্তী বলেন যে, উনাদের মারধোর করার সময় আক্রান্ত কারীরা বার বার বলেছিলো যে, ভালো করে বুঝে নে পঞ্চায়েতের সাথে লাগালাগি করলে কি অবস্থা হয়, ভালো করে বুঝে নে। এই কথা গুলো বলে উনাদের আক্রমণ করা হয়

তবে, সাংবাদিক সম্মেলনে বাগানের ম্যানেজার রাজ কুমার গুপ্তা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, সমস্ত ঘটনার সাথে তিনজন মাস্টার মাইন্ড জড়িত। এই তিনজন মাস্টার মাইন্ড শাসক দলের নেতা এবং শাসক দলের সাথে জড়িত। এই তিনজন শাসক দলের মাস্টার মাইন্ডের আংগুলি হেলনে এবং ওদের উস্কানিতেই শ্রমিকরা এই ঘটনা করেছে। এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে চৌদ্দ শনিবার রাতে ঊনকোটি জেলার জেলাশাসক ডা: বিশাল কুমার ফোনে বাগান ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলার পর বাগান ম্যানেজার কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে, বাগান শ্রমিকরা ক্যামেরার সামনে কিছু না বললেও এটা জানান যে, বাগানের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার গুপ্তা এবং এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সোমনাথ চক্রবর্তী বাগান শ্রমিকদের সাথে প্রতিনিয়তই অভব্য এবং অশালীন আচরণ করতেন। এমনকি বাগানের মহিলা শ্রমিকদের সাথেও খারাপ ব্যবহার করতেন এবং বাগানের মহিলা শ্রমিকদের শরীরে হাত লাগাতেন বলেও ম্যানেজারদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করেন। এমনকি শ্রমিকরা এও জানান যে, বাগানের মহিলা শ্রমিকদের সাথে অভব্য আচরনের ভিডিও ফুটেজ নাকি বাগান শ্রমিকদের কাছে রয়েছে। তবে ভোটের প্রাক্কালে এভাবে শতবর্ষ পুরনো চা বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা হলেও এর প্রভাব ভোটে পড়বে বলে অনেকেরই অভিমত। তাছাড়া বাগানের ম্যানেজাররা এভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে  শাসক দলের নেতাদের উস্কানিতে এই ঘটনাটি ঘটেছে বলায় শাসক দলের পক্ষ কি ধরনের ভুমিকা নেওয়া হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। অন্যদিকে বাগান ম্যানেজারদের মারধরের ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হওয়ায় গোটা কৈলাসহর মহকুমায় ভোটের প্রাক্কালে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মাত্র এক হাজার টাকা আদান-প্রদানকে ঘিরে যুবকের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ
Next post রতন নাথের বাড়ি ঘেরাও করল যুব কংগ্রেস
%d bloggers like this: