কৃCকৃষক আন্দোলনের চতুর্থদিনেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে শাম্ভু সীমান্ত।

ভারতে আন্দোলনকারী কৃষক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে শুক্রবার আরও একবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল পাঞ্জাব-হরিয়ানার মধ্যবর্তী শাম্ভু সীমান্ত।

নূন্যতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা, কৃষি ঋণ মওকুফ এবং স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন-সহ একাধিক দাবি নিয়ে আন্দোলনকারী কৃষকেরা ওই সীমান্তে থাকা নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে এগোতে চাইলে দু’পক্ষের মধ্যে আরও একবার সংঘর্ষ বাঁধে বলে জানিয়েছেন প্রতিবাদকারীরা।

পুলিশের অভিযোগ তাদের তাক করে পাথর ছোঁড়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুঁড়েছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের সময় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশি পদক্ষেপ, জল কামান ও ড্রোনের মাধ্যমে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফেলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কৃষক নেতারা।

‘অল ইন্ডিয়া কিষাণ কংগ্রেসের’ চেয়ারম্যান সুখপাল সিং খারিয়া বলেন, “একদিকে কৃষকদের মারধর করা হচ্ছে। অন্যদিকে, তাদের বৈঠকের জন্যও ডাকছে! ওরা (আন্দোলনকারী কৃষকরা) কিন্তু তাও আলাপ আলোচনায় যাচ্ছেন। রাত একটার সময় যখন বৈঠকের জন্য মন্ত্রীরা ডেকেছিলেন তখনও গিয়েছেন কৃষক নেতারা। তারা কখনই আলাপ-আলোচনা থেকে মুখ ঘোরায়নি। বরং সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করেনি।”

অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা যেন নিজেদের কথা শান্তিপূর্ণ ভাবে রাখেন সে বিষয়ে আবারও জোর দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা।

শুক্রবার সকালে তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, “আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সব আলাপ আলোচনা হোক। অব্যবস্থার মাধ্যমে কোনও ব্যবস্থা করা যায় না।”

আন্দোলনের চতুর্থদিন অর্থাত্‍ শুক্রবার বন্ধের ডাক দিয়েছিল কৃষক সংগঠন।

সমমনোভাবাপন্ন সংগঠন, গ্রামীণ প্রকল্পে কর্মরত এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলিকে এই বন্ধে সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

সকাল ছ’টা থেকে শুরু হয়েছে ‘গ্রামীণ ভারত বন্ধ’ যা চলেছে বিকেল চারটে পর্যন্ত। এর পাশাপাশি বেলা ১২ টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ‘চাক্কা জাম’ করার কর্মসূচীও নেওয়া হয়েছিল।

এর প্রভাব পড়ে দিল্লি, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায়। পাঞ্জাব, হরিয়ানায় বহু দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকায় তীব্র যানজটের মুখে পড়েন বহু মানুষ।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার সকালে আন্দোলনরত ষাটোর্ধ এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ভোরবেলা হৃদরোগে আক্রান্ত হন গুরদাসপুর জেলার বাসিন্দা গিয়ান সিং। তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হলেও বাঁচানো যায়নি। শাম্ভু সীমান্তে গত ১৩ই ফেরুয়ারি থেকে আন্দোলন করছিলেন তিনি।

কৃষকদের সমর্থনে জম্মু-কাশ্মীরে লালচকে বিক্ষোভ করছিলেন ট্রেড ইউনিয়ানের নেতা এবং সমাজকর্মীরা। সংবাদ সংস্থা পিটিআই সূত্রে জানা গিয়েছে তাদের মধ্যে ৫০জনকে আটক করা হয়েছে।

পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের কৃষকদের দুটি বড় সংগঠন ‘সংযুক্ত কিষান মোর্চা’ এবং ‘কিষান মজদুর মোর্চা’ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের অধীন পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশের সাড়ে তিনশোটি ছোট-বড় কৃষক সংগঠন রয়েছে।

আন্দোলনের চতুর্থদিন অর্থাত্‍ শুক্রবার সকাল থেকেই শাম্ভু, টিকরি, গাজিপুর ও সিঙ্ঘু-সহ একাধিক সীমান্তে জড়ো হতে থাকেন কৃষক। মঙ্গলবার শুরু হওয়া ‘দিল্লি চলো’ অভিযানে প্রথম দিনে বাধা পেয়ে, সেখানেই অবস্থান করছেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা।

বড় গাড়ি ও ট্র্যাক্টরে চেপে সীমানার দিকে রওয়ানা হওয়া আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। গত তিনদিনের আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল ওই এলাকাগুলিকে। মোতায়েন করা হয়েছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও অ্যান্টি রায়ট ভেহিকেল।

কংক্রিট আর পেরেক পুঁতে, কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে বহু স্তরীয় ব্যারিকেড করা হয়েছিল। মঙ্গলবার থেকেই সরানোর চেষ্টা করে আসছিলেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা। এদিনও একই ছবি দেখা যায়।

তবে প্রশাসনের দমননীতির মোকাবিলা করতে আগেই রণনীতি পরিবর্তন করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে রোদ চশমা পরতে, চোখ-মুখ ঢাকতে, হেলমেট ব্যবহার করতে দেখা যায় প্রতিবাদীদের। ড্রোনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গত দু’দিন ধরে কড়া মাঞ্জা ব্যবহার করে ঘুরি ওড়াচ্ছিলেন প্রতিবাদীরা।

প্রথমে শান্তিপূর্ণ থাকলেও শাম্ভু সীমানার ছবি বদলে যায় শুক্রবার দুপুরে।

একদিকে, পুলিশের অভিযোগ বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তাদের তাক করে পাথর ছোঁড়া হয়েছে। অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ কৃষকদের দাবি, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চান। পুলিশি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার বিকেলেও তেঁতে উঠেছিল ওই সীমান্ত। একাধিক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোঁড়া হয়েছিল। যদিও রাত থেকে সকাল অব্দি পরিস্থিতি শান্ত ছিল ওই সীমানায়।

গ্রামীণ ভারত বন্ধ ও অন্যান্য কর্মসূচী

সংযুক্ত কিষান মোর্চা শুক্রবার গ্রামীণ ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছিল। সকাল ছ’টা থেকে শুরু হয়েছে বন্ধ যা চলেছে বিকেল চারটে পর্যন্ত। বেলা ১২ টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ছিল ‘চাকা জ্যাম’-র কর্মসূচিও। তার জেরে দিল্লি, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্যের কয়েকটি অংশে পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সচেষ্ট ছিল প্রশাসন। তাদের তরফে আগে থেকেই জারি করা হয়েছিল কড়া সতর্কবার্তা।

নয়ডায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। সবরকম জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। রাস্তা আটকে বিক্ষোভের পরিস্থিতি সামাল দিতে আমজনতাকে মেট্রোয় চেপে যাতায়াত করার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ।

এদিকে, কৃষকদের সমর্থনে শুক্রবার পাঞ্জাবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঞ্জাব রোডওয়েজ, পিইউএনবাস এবং বেসরকারী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বাস অপারেটররা ধর্মঘট করেছে। রাস্তা বন্ধ থাকায় অনেক যাত্রী আটকে পড়েন।

পাঞ্জাবের পেট্রোলিয়াম ডিলাররা বন্ধের ডাককে সমর্থন করতে ফিলিং স্টেশনগুলি বন্ধ রেখেছিলেন।

বেশ কয়েকটি কৃষক সমিতির কর্মীরা আম আদমি পার্টি-শাসিত পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীদের তাদের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করেন।

গ্রামীণ ভারত বন্ধের প্রভাব দেখা গিয়েছে হরিয়ানাতেও। সেখানে দোকান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।

দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলেও এর প্রভাব দেখা দেয়। তীব্র যানজটে আটকে পড়েন বহু যাত্রী। টিকরি সীমান্তের কাছে মোতায়েন করা বিপুল সংখ্যক পুলিশ এবং ব্যারিকেডিংয়ের কারণে তীব্র যানজট দেখা গিয়েছিল।

হরিয়ানার ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের জাতীয় সভাপতি ও কৃষক নেতা গুরনাম সিং চারুনি শুক্রবার দুপুর ১২ টা থেকে বিকাল ৩টে পর্যন্ত রাজ্যের সমস্ত টোল প্লাজা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, আন্দোলনরত কৃষকদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে তাদের এই কর্মসূচী।

ওই কর্মসূচী মেনে কিছুক্ষণ টোল প্লাজাগুলি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পর আন্দোলনকারী কৃষকেরা তা ছেড়ে দেন।

তবে ভারতের একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন ধর্মঘটের বিরোধিতা করে তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছে। কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্সের মহাসচিব রাজীব খান্ডেলওয়াল ওই সংঠনের অন্তর্ভুক্ত সকল ব্যবসায়ীদের তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং সাধারণ মানুষকে পরিষেবা প্রদানের বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন।

তৃতীয় দফা বৈঠক

এর আগে, বৃহস্পতিবার রাতে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা, শিল্প ও বাণিজ্য পিয়ূষ গোয়েল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাইয়ের সঙ্গে কৃষক সংগঠনের নেতাদের দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন কৃষক সংগঠনের নেতারা। যদিও তাতে কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি।

সরকারের সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার পর, কিষাণ মজদুর মোর্চার আহ্বায়ক সারওয়ান সিং পান্ধের বলেন, “মন্ত্রীরা বলেছেন তাদের সময় প্রয়োজন। কয়েকটি সম্মেলন আছে এবং তারপর মন্ত্রিসভার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এমএসপির আইন, দেড় গুণ ব্যয় ও ঋণ মওকুফের মতো আমাদের দাবি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।”

মন্ত্রীদের কাছে প্রশাসনের তরফে নেওয়া ‘কড়া দমননীতির’ বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন কৃষক সংগঠনের নেতারা।

মি পান্ধের বলেন, “ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। আমাদের উপর ড্রোনের মাধ্যমে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফেলা হচ্ছে। এটা কেন? আমরা চাইনা অত্যধিক বল প্রয়োগ হোক। সে কথা আমরা সরকারকে জানিয়েছি।”

“আমরা কোথায় পাকিস্তানের নাগরিক? আমরা তো এই দেশেরই কৃষক। দেখে মনে হচ্ছে ওখানেও সীমান্ত আছে আর এখানেও!”

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা।

“আমাদের বৈঠক সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। কৃষক সংঠনের তরফে যে দাবি দাওয়া জানানো হয়েছে, তা আমরা গুরুত্ব সহকারে শুনেছি। সেই প্রেক্ষিতে আমাদের পরবর্তী বৈঠকের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী রবিবার,” বলেছেন মন্ত্রী।

একই সুর শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের গলায়। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি রবিবারের বৈঠকেও সুষ্ঠুভাবে কথা বলার মতো পরিবেশ থাকবে। আশা করা যায় আমরা সত্ত্বর সমাধান পেয়ে যাব।”

কৃষকদের উপর বল প্রয়োগ করা ঠিক নয়

কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে বিজেপি সরকারকে তোপ দেগেছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি।

কৃষকদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে শিবসেনা (ইউবিটি) সাংসদ সঞ্জয় রাউত বলেছেন, “বিক্ষোভকারীরা সারা দেশের কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু যেভাবে তাদের উপর বল প্রয়োগ করে আটকানো হচ্ছে তা ঠিক নয়। এখন পর্যন্ত ১০০ জনেরও বেশি কৃষক আহত হয়েছেন এবং অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বিশাল জেলখানা তৈরি করেছে।”

“স্বাধীন ভারতে যখন কৃষকদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি বিদেশ সফর করছেন, অমিত শাহ একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, কৃষিমন্ত্রীকে কথা বলার অধিকার দেওয়া হয়নি।”

বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই কৃষকদের উপর বল প্রয়োগের নিন্দা করেছিলেন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো।

তার কথায়, “কৃষকরা আন্দোলন করছে, দেশ জ্বলছে কিন্তু বিজেপির কিছু যায় আসে না।”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মধ্যরাতে কুখ্যাত এক গাঁজা মজুদদেরকে পুলিশ জালে তুলতে সক্ষম হয় !
Next post চুক্তি পত্রে তিপ্রা নামে ভুল! এত বড় ভুল প্রদ্যুতের চোখে পড়েনি? তাহলে কি এই চুক্তি পত্রের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন হবে?
%d bloggers like this: